Friday, April 16, 2010

কবির প্রতারণার ফাঁদে প্রবাসী নারী

সেরীন ফেরদৌস

ওরা মূলত: কবি; সঙ্গে কেউ কেউ গান গান, কেউ আবার সিনেমাও বানান। ঢাকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মোটমুটি একটা পরিচিতি আছে এঁদের। সেটিকেই পুঁজি করেই এরা আবির্ভূত হয়েছেন প্রতারক হিসেবে।

ফেসবুকে বন্ধু বানিয়ে রোমান্টিক কবিতায় প্রলুব্ধ করা হয়েছে প্রবাসী নারীদের। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা পরিণত হয়েছেন বন্ধু বা প্রেমিকে। তারপর শুরু হয়েছে নানা অজুহাতে টাকা-পয়সা, অন্যান্য দামী সামগ্রী হাতিয়ে নেওয়া । বেশ কিছু খসিয়ে নেবার পর এরা বন্ধু বা প্রেমিকা পাল্টান, টার্গেট করেন অন্যদের। প্রবাসী বাংলাদেশী নারী, বিশেষ করে চাকরিজীবী নারীরা এদের প্রধান টার্গেট, তবে গৃহবধুরাও এদের শিকার।

নতুনদেশের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রতারণার শিকার প্রবাসী নারীরা দামি উপহারসামগ্রী ( ভিডিও ক্যামেরা, ডিজিটাল ক্যামেরা, গেরস্তালী সামগ্রীর মূল্য, মোবাইল ফোন ইত্যাদি) দেওয়া ছাড়াও নিয়মিত নগদ টাকা পাঠিয়েছে। একপর্যায়ে টাকা পাঠাতে কেউ কেউ অপারগতা প্রকাশ করলে, তাদের পাঠানো উপহার সামগ্রী, মেইল এবং ফেসবুক তথ্য তাদের স্বামী ও অন্যান্যদের জানিয়ে দেবার ভয় দেখানো হয়েছে। এদের মধ্যে দু’একজন দেশে বেড়াতে গেলে গোপনে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকায় গিয়ে থানা-পুলিশও করতে হয়েছে কাউকে কাউকে। তবে সামাজিকভাবে হেয় হবার ভয়ে এবং সংসারে অশান্তির আশংকায় প্রতারিত এসব নারীরা কোথাও মুখ না খুললেও মুষড়ে পড়েছেন এবং কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কানাডার টরন্টো, নিউইয়র্ক, অস্ট্রিয়া, সিডনি এবং মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বেশ কয়েকজন নারী ‘ঢাকাই কবি’দের হাতে প্রতারিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন নতুনদেশের কাছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের মোটামুটি পরিচিতিকে কাজে লাগিয়েই এই সুসংঘবদ্ধ কবির দলটি গত দু’এক বছর ধরে অত্যন্ত নিপুণভাবে এধরণের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে । এর কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি উদঘাটিত হয়েছে।

সংঘবদ্ধ এ চক্রটি সম্পর্কে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছ, বিশেষ করে বাংলাদেশের টাকার বিপরীতে যেসব দেশের মুদ্রামান অতি উচ্চ,সেসব দেশের নারীদের সঙ্গে নানা সম্পর্কের ভূমিকায় অর্থ খসিয়ে নেবার পর্বে নিজেকে নি:স্ব হিসেবে প্রমাণ করতে নানা ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয় এরা। একই সঙ্গে নিজেকে ব্যক্তিত্ববান এবং কাঙ্ক্ষিত হিসেবেও প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকে যাতে চাতুরির আড়ালে নিজের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে না যায়!

উদঘাটিত ফেসবুক প্রতারকদের এ চক্রটির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে- এরা মূলত কবি, নির্দিষ্ট কোনো অর্থ আয়ের ব্যবস্থা এদের কারোরই নেই অর্থাৎ কোনো চাকরি-বাকরি করে না, প্রায় সারাক্ষণই ফেসবুকে পরে থাকে, কেউ কেউ শর্ট ফিল্ম বা টেলিফিল্ম বানায় বা বানানোর চেষ্টা করছে, বিখ্যাত প্রমাণ করতে নিজেদের ছবি তুলে নিয়মিত ফেসবুকে পোস্ট করছে, এরা নিয়মিত বা অনিয়মিত মাদকাসক্ত এবং একধরনের ভবঘুরে প্রকৃতির। কোন নারীর হাতে কিরকম টাকা আছে সে বিবেচনায় এরা বিদেশে থাকা নারীদের কাছে প্রধানত দামী ক্যামেরা চেয়ে বসে। মূল দাবি উচ্চমূল্যের ভিডিও ক্যামেরা, না পারলে ডিজিটাল ক্যামেরা। ৮টি ইনডেপ্থ কেস-স্টাডির ৬টি ক্ষেত্রেই এরা দামী ভিডিও ক্যামেরা চেয়েছে। ২/৩টি ক্ষেত্রে শিকার নারী ভিডিও ক্যামেরা হয় পাঠিয়ে দিয়েছে কাউকে দিয়ে, নয় নিজেই যখন বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছে, ক্যামেরা উপহার হিসেবে দিয়েছে। এসব নারীরা যেহেতু একজন আরেকজনের খবর জানেনা, তাই একজনের কাছ থেকে ক্যামেরা নিলেও আরেকজনের কাছে একই সময়ে ঠিকই আরো ক্যামেরা দাবি করেছে।

প্রবাসী যেসব নারীরা স্বেচ্ছায়/অসাবধানতাবশত: এই চক্রে পা দিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে ‘ফেসবুক’ একটি ম্যাজিক মিডিয়া হিসেবে কাজ করেছে। বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব নারীদের এইসব প্রতারক কবিদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে। বাস্তবিক অচেনা এবং ভার্চুয়াল চেনা কবি অথবা শিল্পীটির নানারকম ‘ওয়াল’ এবং ‘ইনবক্স’ ম্যাসেজের চক্করে পরে শৈল্পিক কথাবার্তার জালে নারীটি ক্রমশ: জড়িয়ে পরতে থাকে। সাংসারিক টানাপোড়েন, দৈনন্দিন একঘেঁয়েমি, ব্যক্তিগত শূন্যতা, এ্যাডভেঞ্চার অথবা নিতান্তই বাজিয়ে দেখা...ইত্যাদি থেকে যোগাযোগ গড়াতে গড়াতে শেষপর্যন্ত একধরণের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। দু’একটি ক্ষেত্রে নারীটি ‘স্রেফ বন্ধুত্ব’ উল্লেখ করলেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এই প্রেম শরীরকে কেন্দ্র করে নিয়মিত ‘টেলিসেক্স’ পর্যন্ত গড়িয়েছে।

প্রথম প্রথম ফেসবুকের ‘ওয়াল’ এ কবিতা পোস্ট ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ, ইনবক্সে মেইল চালাচালি, পরবর্তীতে ই-মেইল, চ্যাটিং এবং ফোনের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে বলে এই প্রতিবেদককে নারীরা জানিয়েছে। এসময় কবিরা ফোনে কবিতা আবৃত্তি করে, গান গায়, ‘জীবন’ ও ‘সম্পর্ক’ বিষয়ে গভীর অনুভূতির আদান-প্রদানমূলক কথাবার্তা বলে এবং অধীর আগ্রহে নারীটির জন্য অপেক্ষা করে আছে অথবা নারীটিকে এমনকি বিয়ে করতে চায় বলে প্রগাঢ় ভালোবাসামূলক কথাবার্তা বলে। মানসিকভাবে যখন নারীটি যখন সম্পূর্ণ কব্জাগত হয়ে যায় তখন নারীদের সহানুভূতির সুযোগ নিতে কবি কখনো অসুস্থ হওয়ার ভান করে, কখনও কাউকে ধার দিয়ে টাকা ফেরত পাচ্ছে না বলে, কখনো টেলিফিল্ম বানানোর ক্যামেরা নেই, ছবি সেন্সরবোর্ডে আটকে গেছে, কখনো ওয়েব-ম্যাগাজিন করার নাম করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কবিরা ‘প্রেমিকা’র কাছে নিজের ‘মান’ বাড়াতে তার সঙ্গে ফেসবুকে সংযুক্ত অন্য নারীদের (এদের কেউ কেউ-ও ভিকটিম) সম্পর্কে নানারকম বাজে মন্তব্য করতে থাকে এবং প্রেমিকাই চূড়ান্ত ‘স্পেশাল’ বলে মন্তব্য করতে থাকে।

এসব নারীদের মধ্যে যারা নিজেরা আয় করছেন তারা নিজেদের আয়ের অংশ থেকে, আর যাদের নিজেদের আয় নেই, তারা স্বামীর আয় থেকে ‘পকেটমার’ করছেন। কেউ কেউ দামী ক্যামেরা (ডিজিটাল এবং ভিডিও) পাঠিয়েছেন এসব ‘কবি-ফিল্মমেকার’ প্রেমিকের জন্য, কেউ নিয়মিত ‘মাসোহারা’ পাঠিয়েছেন এই ‘দরিদ্র’ প্রেমিকদের জন্য, কেউ কেউ ‘অসুস্থ প্রেমিকে’র জন্য ওষুধ-পথ্যের টাকা পাঠিয়েছেন, কেউ কবির বই বের করার পয়সা দিচ্ছেন, কেউ প্রেমিকের ‘ওয়েব-ম্যাগ’ চালানোর জন্য নিয়মিত ডলার পাঠাচ্ছেন। ‘কারো অধীনে চাকরি না-করা’ এইসব প্রেমিকদের ব্যাংক এ্যাকাউণ্ট সরবরাহ করা হয়নি ‘প্রেমিকা’ বা ‘বন্ধু’দেরকে। কোনো প্রমাণ না রাখার জন্যেই কবিরা জানিয়েছেন, তাদের নাকি কোনো ব্যাংক এ্যাকাউণ্ট ‘নাই’! ডলার পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে নারীরা হুণ্ডি, হাতে হাতে কাউকে দেয়া বা ‘ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়ন’ নামক প্রাইভেট কোম্পানীকে ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে নিজ হাতেই এসব দিয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই চ্ক্রটির সদস্যরা পরষ্পর পরষ্পরকে খুব ভালো করেই চেনে এবং বন্ধু। কম-বেশি পরষ্পর মাদকের আসর-সঙ্গী। যদিও একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নারীকে হ্যাণ্ডেল করার সময় বন্ধুরা খুব দ্রুত পরষ্পরকে তথ্য প্রদান করেছে, কিন্তু ভিকটিম নারীদের কাছে একজন অন্যজনকে ‘কম চেনে’, ‘ও মাতাল’, ‘ও আমার এ্যাসিসট্যান্ট’, ‘ও ছিনতাইকারী-বখাটে’ ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত করেছে। ইদানিং এসব প্রবাসী নারীদের দু’একজন তাদের সঙ্গে সংযুক্ত কবিকে সন্দেহ করতে শুরু করে এবং কবির ফেসবুক ‘অনুসরণ’ করে সম্ভাব্য প্রেমে পড়া নারীদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে গেলে বিষয়গুলো ফাঁস হয়ে যায় এবং নারীরা হতভম্ভ হয়ে পরে!

‘নতুনদেশ’ এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই সময়ে একই ব্যক্তি তিনটি ভিন্ন দেশের তিন নারীর কাছে থেকে একই প্রেমময় বক্তব্যের বিপরীতে নিয়মিত মাসোহারা নিয়েছে। একপর্যায়ে কেসস্টাডিগুলোর মধ্যে একজন টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে প্রতারকরা তার স্বামীকে জানিয়ে দেবার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। একটি ক্ষেত্রে একজনের স্বামীকে জানিয়ে দেয়াও হয়েছে। যেহেতু প্রতিটি ক্ষেত্রেই, নারীরা তাদের স্বামীদেরকে বিষয়টি জানাতে চায়না, ফলে প্রতারকদের হুমকির মুখে বর্তমানে তারা চাপের মুখে আছে।

সম্প্রতি, সুমনা মেহরীন নামে ঢাকার একজন কবি ঢাকার জনৈক আরেক কবির প্রেমে পরেন এবং তাদের ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে এ সম্পর্ক নিয়ে নানা জটিল টানা-পোড়েনের শিকার হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। সুমনার আত্মহত্যা পরবর্তী সময়ে নতুনদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লেখিত প্রতারক দলটির সঙ্গেও সুমনার বন্ধুত্ব ছিলো এবং এ সংক্রান্ত নানা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল।

নতুনদেশের এ প্রতিবেদককে বেশ কয়েকজন নারীই অকপটে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা স্বীকার করে বক্তব্য দেন এবং নানা প্রমাণ উপস্থাপন করেন। অনুসন্ধান চলাকালে গত দু’মাসের মধ্যে দুটি ক্ষেত্রে ‘কবির সঙ্গে ভিকটিমে’র কথাবার্তা টেপ করা হয়েছে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের প্রমাণের তুলনা করে এই কবিচক্রটির পাঁচ সদস্যকে সনাক্ত করা হয়েছে।

(প্রতারণার বাছাই করা কয়েকটি কাহিনী প্রকাশিত হবে আগামী সংখ্যায়)

No comments:

Post a Comment