Thursday, April 22, 2010

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : দুঃখিত, গালিব

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

কয়দিন ধইরাই ভাবতেছিলাম গালিবের নোটটা লইয়া বিশাল কিছু লিখি। অ্যায়সা এক কাজের মৌচাক মাথায় ভাইঙ্গা পড়ল, আমি সময়েরে পাব কি, সময়ই পায় না আমারে। তয় মনে-মনে লিখতেছিলাম লেখাটা, আর ফি-সুবা একএক-জনার কমেন্ট পড়তেছিলাম পাঁচসকালে উইঠা। তো কালকে আমার এক বাল্যবন্ধু মারা গেল... আর নির্বেদ ভর করল আমারে, আমার মৃত স্বজনেরা সব ঘুরতে নিল আমার মাথার চারিপাশে, বুকের, চোখের চারিপাশে... মনে হইল, এইসব তক্কাতক্কির লগে আমার তালুক কী। তাই, লেখিষ্যমাণ নোটটা মনে-মনে মুইছা ফেললাম, আমার সদ্যঃ বন্ধুবিয়োগের যাতনা খানিক লাঘব হইল তখন, আমার মরহুমগণের লগে বিশ্রম্ভালাপের সুবিধা হইল...

খুব সংক্ষেপে কয়ডা কথা কই বরং:

গালিবের নোটে আমার মনঃকষ্ট হইছে; হইছে সে আমার স্নেহের, অনুরাগের পাত্র বইলা, তার কাছে, নানা কারণে, আমার প্রত্যাশা একটু বেশি বইলা...

তাইজন্যই, আরও, আমার কিছু লিখনের ইচ্ছায় একটা অদৃশ্য শাকের আঁটিও চাপতেছিল, সময়-স্বল্পতার বোঝার উপর। কেননা, এইরকম, আগেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা এম্ফ্যাটিক রচনার উপরে আসলে আলোচনা করা যায় না। প্রস্তাবনা থিকা আলোচনা, আলোচনার থিকা সিদ্ধান্ত আসতে (বা না-আসতে) পারে। উল্টাটা হইলে সিদ্ধান্তের জবাবে প্রতি-সিদ্ধান্ত, গালির জবাবে গালি... তয়, এই সিলসিলায়, আমি ফিরোজ আহমেদরে সালাম দিয়া রাখি; এই ক্রসফায়ারের মাঝখানেও সুস্থির ও যুক্তিনিষ্ঠ থাকতে পারার জন্য...

হিন্দু-মুসলমান লইয়া চুলাচুলি কত যে ন্যক্কারজনক! কোনো জাতি- বা ধর্মীয় গোষ্ঠিরে নিয়া জেনারালাইজিং কুমন্তব্যও কী যে ভীষণ অপরাধের – মানে এমতো বলা, যে “হিন্দুরা” অমন, “মুসলমানেরা” তমন... আর আমার ব্রেইন শুকাইয়া পাথর হইতে নিলে আমি শুনি ফৈয়াজ খাঁ হোরি গাইতেছেন “বন্দে নন্দকুমারম্”, হঁ, শেষে দ্বিতীয়ার অম্ সহ, মানে খালি যে যবনের ব্যাটা শ্রীকৃষ্ণ বন্দনা করতেছেন তাই না, করতেছেন একেবারে সংস্কৃতে; আবার ঐদিকে দ্যাখো কাফেরের বাচ্চা যশরাজ মিয়াকি তোড়িতে আল্লাহ জানে আল্লাহ জানে কানতেছে... আমগোর আগের কালের কবিরা তো সকলেই কাফের আর মুনাফেক ছিলেন... হননীয় বদমাশ সৈয়দ সুলতান “নবীবংশ”-এ রামচন্দ্র, গৌতম বুদ্ধরে ঢুকান, কোনো এক বদ হিন্দু পিরের বন্দনায় আমাদের সাহিত্যের উষালগ্নে লেখেন “সেক শুভোদয়া”... আমি শুনি আমার ঢাকার হিন্দু বন্ধু তপনা (তপন) ঢাকাইয়া ভাষাতেই কথা কয়, আমার মুসলমান বন্ধু শওকাতের বুলির লগে তার বুলির একমাত্র পার্থক্য হইল হে পানিরে জল কয় আর শওকাত জলেরে পানি, তপনারে যদি কই তুই মুসলমানের ভাষায় কথা ক’স, ব্যাটা হয়তো বুঝতেই পারবো না আমার বক্তব্য। প্রত্যুত, একরাম (আলি) দা একবার ঢাকায় আইল, তার মুখের ভাষার লগে গৌতম দা-র জবানের কোনো ইতরবিশেষ দেখলাম না। কোনটা হিন্দুর, কোনটা মুসলমানের ভাষা? আর, আমার ভাষা? এইটার অধিকারী কেটা? গালিব না কুলদা?

আমার-ভাষা নিয়া, ভাইবা দেখলাম, আমার বলার কিছু তেমন নাই। ট্যাকাপয়সা লইয়া কথা কওয়া একটা অসভ্যতা যেমন, তেমনি নিজের ধর্ম, নিজের ঘরের মানুষ, ঘর, দেশ, ভাষা নিয়া বাগাড়ম্বরও অভব্য আচরণ। ভাষা নদীর লাহান, তা মাঝে-মাঝে হৃতস্রোতা হয়, মাঝে-মাঝে কূল ভাসায়; মাঝে-মাঝে গ্লেসিয়ার জইমা মৃত ভাষা হইয়া যায়, আবার গইলা গিয়া নোতুন নোতুন নানা খাতে নানা নামে দক্ষিণপ্রবাহিণী হয়...

লেখকের কলমে জোর থাকলে তথাকথিত আঞ্চলিক ভাষাতেও ফাটাইয়া দেওয়া যায়, উদাহরণ দান্তে। জোর না-থাকলে সংস্কৃত গ্রিক লাতিন আরবিতেও আবর্জনা ফলানো যায়; এর উদাহরণের দরকার নাই। আমার-ভাষা বাবদে নীচের কবিতাটার চেয়ে বেশিকিছু আমার বলার নাই আসলেই :

ওরা তোরে ভুলে গেছে, অথবা চেয়েছে তা-ই, ওদের স্মরণে
টলোমলো পায়ে, আহা, প্রথম-দাঁড়ানো তুই আর
তুলিস না ‘তা-তা’ ধ্বনি - অকাল মরণে
ননির পুত্তলি, তুই হয়েছিস এত গুরুভার!
যে ঐ নিবিড় ব্যূহ ভেদ ক’রে, তোর
একান্ত, নিজস্ব, ছোট্ট, দুর্গটিকে করেছে দখল,
তারে তুমি ক’রে দিয়ো আপনাতে অমনি বিভোর -
তোর ছোট বোনটিরে - দিয়ো সে-সকল
ঈশিতার প্রতিভাস, আধো-হাসি-মুখে - আর, সে-মহান্ ভাষা,
যে-ভাষা হিরের মতো স্বচ্ছ, দ্যুতিময়,
ঘুমঘোরে ঝলসে উঠে দূরতম নক্ষত্রের নীরব আলোয়
একাই যে একশ’ ছিল এক রাত, ত্রিলোকের জাগর-পালায় -
যে-কোনো চীনারও কানে ছিল তা প্রাঞ্জল - তবু আশা :
ও আমার বড় মেয়ে, যা-কিছু বলেছ তুমি, বলেছ বাংলায়।

(পুলিপোলাও ৬, মে ১৯৯৫)

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (উনি কেরানি ছিলেন!), বিদ্যাসাগর (উনিও!!!), মাইকেল, (সাম্প্রদায়িক) বঙ্কিম, (অসাম্প্রদায়িক) মীর মশাররফ, ভাই গিরিশচন্দ্র, দীনেশচন্দ্র, রবিঠাকুর, নজরুল সহ সকল কালের সকল স্থানের সকল বাংলা লেখকেরে প্রণাম।

*সোহেল হাসান গালিবের নোটটি দেখুন--http://www.facebook.com/profile.php?id=1573787229&ref=profile#!/notes/sohel-hasan-galib/andha-jatiatabada-kulada-ra-bikrti-o-adhyapaka-khondakara-asarapha-hosena/386678993534

*অন্ধ জাতীয়বাদ,কুলদার বিকৃতি,অধ্যাপক খোণ্দকার আশরাফ হোসেন-- গালিবের নোটটি এখানেও পাবেন-
* গালিবের নোট--কে এই কুলদানন্দ: মানুষ না পাখি

No comments:

Post a Comment